দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমী

মাত্র কয়েক দিন আগে যেখানে ছিল আলোর রোশনাই, ঢাকের শব্দ, আড্ডার মাদকতা আর অনাবিল আনন্দ সেখানেই এখন নীরবতা আর শূন্যতা। ঠাকুরদালানে জ্বলতে থাকা প্রদীপের মৃদু আলোয় তখন শুধুই খেলে বেড়ায় আলো-আঁধারির স্মৃতিকথা। প্রতি বছর পুজো শেষে এটাই পুজো প্রাঙ্গণের পরিচিত ছবি। নিজের অজান্তেই ছলছল করে চোখ দু’টি। ঠিক যেন আপনজনের দূরে চলে যাওয়া বেদনা গ্রাস করে অবুঝ, সরল মনকে।

নবমী নিশি পেরোতেই বিষাদের করুণ সুর বেজে ওঠে মনে। ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন তখন ঘোর বাস্তব। পাঁচ দিনের উৎসবের রেশ রয়ে যায় বছর ভর। এমনই এই উৎসবের মহিমা। তবু পুজোর ক’টা দিনের উষ্ণ মুহুর্ত যেন হয়ে ওঠে সারা বছরের আনন্দের উৎসবিন্দু।

বিজয়া দশমী

রথযাত্রা কিংবা জন্মাষ্টমীতে যার প্রস্তুতির সূচনা তারই সমাপ্তি ঘটে নবমী নিশিতে। এমনটাই তো চলছে যুগ যুগ ধরে। তবু মন মানে না। পুজোয় রঙিন মুহূর্তগুলো যেন ঘুরে ফিরে আসে কর্মব্যস্ত একঘেয়ে জীবনের আনাচে কানাচে। হয়তো এই কারণেই কখনও একঘেঁয়ে লাগে না পুজোটাকে।

ঠাকুর থাকবে কতক্ষন, ঠাকুর যাবে বিসর্জন! দশমীর সকাল থেকেই ঢাকের কাঠি, তাই বলে যাচ্ছে। পুজো, পুজো, পুজো, পুজো শেষ। কাল থেকেই স্কুল, কলেজ, পড়াশোনা, দৈনন্দিন জীবনযাপন। বিসর্জনের পরও, নিরাকার দেবী সারা বছর থেকে যাবেন আমাদের কাজের মধ্যে, আমাদের অধ্যবসায়। বিদায়কালে, এই চেতনাই আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে।

দশমীর সন্ধ্যা থেকেই আবারও শুরু হয় এক বছরের নীরব প্রতীক্ষা। মাটির বেদীর উপরে তখন প্রতিমার পরিবর্তে শোভা পায় শুধুই প্রাণহীণ প্রতিমার পাটা। এ যেন বছর পেরিয়ে আপন মেয়ের ঘরের ঘরে ফেরা। তাইতো মিশে আছে এত আনন্দ, এত আন্তরিকতা। আর বিজয়া মানেই মেয়ের ঘরে ফেরার জন্য আবার এক বছর প্রতীক্ষার সূচনা। তাই মন খারাপ হয়। আজও দশমী এলেই মনে পড়ে যায় মেয়ের বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা।

দুর্গা পূজার অন্ত চিহ্নিত হয় বিজয়া দশমীর মাধ্যমে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই দিনেই পিতৃ-আবাস ছেড়ে দেবী পাড়ি দেন স্বামীগৃহ কৈলাসের দিকে। এই দিনেই তাই দেবীর প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। ভারত ও নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দিনটি নানাভাবে পালিত হয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দিনটিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয় কেন? কোন ‘বিজয়’-কেই বা চিহ্নিত করে দিনটি?

‘দশমী’ কথাটির প্রাসঙ্গিক তাৎপর্য সহজবোধ্য। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে দেবী কৈলাস পাড়ি দেন। সেই কারণেই ‘বিজয়া দশমী’ নাম। কিন্তু এই দশমীকে ‘বিজয়া’ বলা হয় কেন, তার পৌরাণিক ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে একাধিক কাহিনি সামনে আসে। পুরাণে মহিষাসুর-বধ সংক্রান্ত কাহিনিতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পরে দশম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন দেবী। শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনি অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবী আবির্ভূতা হন, এবং শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর-বধ করেন। বিজয়া দশমী সেই বিজয়কেই চিহ্নিত করে।

তবে উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই দিনে যে দশেরা উদযাপিত হয়, তার তাৎপর্য অন্য। ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ‘দশহর’ থেকে, যা দশানন রাবণের মৃত্যুকে সূচিত করে। বাল্মীকি রামায়ণে কথিত আছে যে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই রাবণ-বধ করেছিলেন রাম। কালিদাসের রঘুবংশ, তুলসীদাসের রামচরিতমানস, কিংবা কেশবদাসের রামচন্দ্রিকা-য় এই সূত্রের সঙ্গে সংযোগ রেখেই বলা হয়েছে, রাবণ-বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ। রাবণ-বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষেই যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে।

আবার মহাভারতে কথিত হয়েছে, দ্বাদশ বৎসর অজ্ঞাতবাসের শেষে আশ্বিন মাসের শু‌ক্লা দশমীতেই পাণ্ডবরা শমীবৃক্ষে লুক্কায়িত তাঁদের অস্ত্র পুনরুদ্ধার করেন এবং ছদ্মবেশ-মুক্ত হয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করেন। এই উল্লেখও বিজয়া দশমীর তাৎপর্য বৃদ্ধি করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url